Sunday , 5 January 2025
new year

স্বাগতম ২০২৫ নববর্ষ : বিদায় ২০২৪

বিশ্বব্যাপি পালিত নানা জাতিগোষ্ঠীর উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হিসেবে মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। তাই বর্ষবরণের প্রাচীনতা ঐতিহ্যের ধারক। পৃথিবীর সব দেশে ও সব জাতির মাঝেই নববর্ষ পালনের রীতি বিদ্যমান। পুরোনো বছরের আনন্দণ্ডবেদনা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, জরাজীর্ণতাকে পেছনে ফেলে আবারও আমাদের মাঝে চলে এলো আরো একটি নতুন বছর। উদয় হলো নতুন দিনের নতুন সূর্যের। পুরোনোকে ঝেরে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুনকে স্বাগত জানানোর যে রীতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তাই নববর্ষ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে যতগুলো অব্দ বিদ্যমান তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশে প্রচলিত অব্দ হলো খ্রিস্টাব্দ। ৫৩০ খ্রিস্টাব্দে দিউনিসউথ প্রথম এ অব্দের প্রচলন করেন। তখন ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত খ্রিষ্টাব্দে বছরের প্রথম দিনটি পড়ত।

বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে বরণ করে উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে। আসলে প্রতিটি উৎসবই আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে, হোক তা আমাদের দেশীয় বা জাতীয় কিংবা অন্য দেশীয় বা বিজাতীয়। আনন্দণ্ডবেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা,প্রাপ্তি-প্রবঞ্চনার হিসাব-নিকাশ পেছনে ফেলে নবপ্রজন্ম নতুন বছরকে স্বাগত জানায় আগামী দিনের নতুন স্বপ্নে সোনালি প্রত্যাশার পাখা মেলে। তাইতো নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে- ‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বর্ষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।’ আবার সাহসিকা জননীখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন- ‘অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে/ সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/ দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/ বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/ দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।

বাংলাদেশে সুদীর্ঘকাল থেকে তিনটি দিনগণনা সন বা বর্ষের প্রচলন রয়েছে, আর তা হলো- খ্রিস্টীয় সন, বাংলা বা বঙ্গাব্দ সন ও হিজরি সন। আবার এসব বর্ষ প্রচলনের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানুষ প্রথমদিকে চাঁদের হিসাবেই নতুন বর্ষ গণনা শুরু করে। চাঁদের হিসাবে ১০ মাসে বছর হতো। সেখানে ঋতুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর এবং চন্দ্র গণনায় আবার পার্থক্য রয়েছে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে কিন্তু চন্দ্র গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ অনুসরণ করি প্রকৃত অর্থে তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মূলত সৌর বছর। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটির সংস্কার সাধন করেন। এ গ্রেগরির নামে এ ক্যালেন্ডার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হয়।

এ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে এডি লেখা হয় তা লাতিন অ্যানো ডোমিনির সংক্ষিপ্ত রূপ। এ অ্যানো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভুর বছর অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ। ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াস নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশু খ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে হিসাব করে এ খ্রিস্টাব্দ লিখন রীতি চালু করেন। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে। তা’ ছাড়া সম্রাট জুলিয়াস সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। তার মতে, ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে হিসাবের কোনো গড়মিল হয় না। আর তাই মোসাজিনিস অতিরিক্ত এক দিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম করেন ‘লিপইয়ার’।

খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্ধারণ করা হয়েছিল নববর্ষ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছিল না। পরে সম্রাট নুমা পল্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করেন, তবে নির্ধারণ করে দেন জানুয়ারির ১ তারিখ হলো বছরের প্রথম দিন; ওই দিনই হবে বর্ষবরণ। কিন্তু সে কথাও মানা হলো না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগলেন। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেই দিনই হবে। এরপরই বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এলো জানুয়ারিতে।

মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে যখন জুলীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করা হত, বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়র ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ গণনা করা হতো; যেমন- ১ মার্চ, ২৫ মার্চ, ১ সেপ্টেম্বর, ২৫ ডিসেম্বর। পরবর্তী সময়ে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ সালে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিয়ে এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন এবং গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি চালু করেন। তারই নামানুসারে যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিতি লাভ করে। যার ফলে পুরোনো পদ্ধতি ও নতুন পদ্ধতির তারিখগুলোতে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয় যার ফলে নতুন বছরের জন্য বিভিন্ন স্থানীয় তারিখের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট তারিখ ১ জানুয়ারি প্রবর্তিত হয়।

রীতি অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখে বাংলাদেশে নিউ ইয়ার উদযাপন করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর দিন পেরিয়ে শূন্য ঘণ্টা থেকে শুরু হয় উৎসব। রাতের এ উৎসবকে বলা হয় ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এ উৎসবের জনপ্রিয়তা লক্ষণীয় হলেও গ্রামাঞ্চলে এ উৎসব উদযাপনের রেওয়াজ এখনো তেমন চালু হয়নি।

জানুয়ারির ১ তারিখে নববর্ষ উদযাপন করার রীতিটি এসেছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হতে যেখানে বছরের শুরু হয় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। বিশ্বের যেসব দেশ এ ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা সবাই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে। তবে অনেক দেশই ক্যালেন্ডারটি গ্রহণ করার পূর্বে নববর্ষের রীতিটি গ্রহণ করেছে। যেমন- ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ড এবং ১৭৫২ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলো নববর্ষের রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে পরিচিত হয় ওই বছরের সেপ্টেম্বরে।

আধুনিক বিশ্বে নববর্ষ হিসেবে ১ জানুয়ারিকে প্রচলিত করার ব্যাপারে ‘রিপাবলিক অব ভেনিস (বর্তমানে বিলুপ্ত) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ তারা ১৫২২ সাল হতে এ দিনকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনা করতে শুরু করে। এরপর ১৫৫৬ সালে স্পেন, পর্তুগাল; ১৫৫৯ থেকে প্রুশিয়া, সুইডেন; ১৫৬৪ সালে ফ্রান্স; ১৭০০ সাল হতে রাশিয়া এ রীতি অনুসরণ শুরু করে। অন্যদিকে ইংরেজি নতুনবর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন- ইসরায়েল। দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। তবে ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ, সে দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী এই রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। আবার মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন- সৌদি আরব, ইরান, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া ও নেপাল। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।

পুরোনো গ্লানি মুছে নতুনভাবে বাঁচার প্রত্যয়ে শুরু হয় নববর্ষ। যে কারণে উন্মাদনাও একটু বেশি থাকে নববর্ষকে ঘিরে। বিভিন্ন উৎসব পার্বনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই নতুন দিনে নতুন বছরে আমাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া এবং আশা-প্রত্যাশাও ব্যাপক। তার অনেকটাই পূরণ হবে আবার কিছুটা পূরণ নাও হতে পারে। তারপরও বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। কেননা সেই অধরা স্বপ্নই হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে। তাই আমরা স্বপ্ন নিয়েই এগোতে চাই। আজ যে নতুন অরুণোদয় হলো নতুন সকালের উদয় হলো সে সকাল জাতিকে আরো উজ্জীবিত দিন এনে দেবে- এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

পরিশেষে নতুন বছরে কামনা, পুরোনো বছরের ভুলগুলো শুধরে ইতিহাস থেকে ভালো ভালো শিক্ষা গ্রহণ এবং অতীতের সফলতাণ্ডব্যর্থতাকে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সামনের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। তার সঙ্গে প্রত্যাশা রইল নতুন বছর সব ধরনের স্থবিরতা কাটিয়ে সবার জীবনে কল্যাণ বয়ে আনুক; আনুক শান্তি-সমৃদ্ধি-স্বস্তি। বাংলাদেশের মানুষ থাকুক সদা দুধে-ভাতে এ প্রত্যাশা রইল আজকের এ শুভ দিনে; শুভ নববর্ষ ২০২৩ খ্রি.। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

সাপ্তাহিক হাজীগঞ্জ রিপোর্ট
জানুয়ারি ১ , ২০২৫
এজি

model (1)

এছাড়াও দেখুন

amon

আমন মৌসুমে ১০ লাখ মে. টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার

আগামি আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য সচিব মো.মাসুদুল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *