দেশের ১০ কোটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর সাত মাস পূর্ণ হয়েছে। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে এ কর্মসূচিতে যোগ দেন মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন।
তৃতীয় মাসে তা আরও ভাটা পড়ে; ১ হাজার ১৩৪ জন অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর প্রতি মাসেই কমছে। সব মিলিয়ে সাত মাসে এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ২৭ হাজারের কিছু বেশি মানুষ, যা লক্ষ্যমাত্রার এক শতাংশেরও বেশ কম। সরকার আশা করেছিল সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিমে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।
এই অবস্থার মধ্যে স্বশাসিত,স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামি জুলাই থেকে যোগ দেওয়া চাকরিজীবীদের সার্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। তারা বিদ্যমান পেনশনের বদলে সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে বৃহস্পতিবার দুপুরে যে তথ্য পাওয়া গেছে,তাতে দেখা যাচ্ছে,এ পর্যন্ত চার স্ক্রিমে ২৭ হাজার ২৬০ জন যুক্ত হয়েছেন। জমা পড়েছে ৩৫ কোটি টাকা। এ অর্থের মধ্যে ৩১ কোটি টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৭ আগস্ট সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিন থেকেই তা সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। প্রথম দিন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ৮ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করলেও পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৭শ জন।
চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন স্কিম রয়েছে। এগুলোর নাম হচ্ছে- প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাস। বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’,স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’,প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস’এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’।
১৭ আগস্ট এ স্কিম উদ্বোধনের পর ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম এক মাসে চাঁদা পরিশোধ করেছিলেন ১২ হাজার ৮শ ৮৯ জন। পরের এক মাসে নতুন করে ১ হাজার ৮ শ ৩১ জন যুক্ত হওয়ায় মোট চাঁদাদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭ শ ২০। তার পরের মাস অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত হয়েছিলেন আরও ১ হাজার ১ শ ৩৪ জন। ওই তিন মাসে মোট চাঁদাদাতা হয়েছেন ১৫ হাজার ৮ শ ৫৪ জন।
হিসাবে করে দেখা যাচ্ছে, পরের চার মাসে অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর থেকে ২১ মার্চ সময়ে এই চার স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৪০৬ জন।
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বকর্ম বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নিয়োজিত কর্মী,স্বল্প আয়ের মানুষ এবং প্রবাসীদের অংশ নেয়ার সুযোগ রেখে চারটি আলাদা স্কিমের ঘোষণা দেয়া হয়।
স্কিমগুলোতে ১০ কোটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নেয় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। তবে ছয় মাস পেরিয়ে ২৭ হাজার মানুষ হিসাব খুলেছেন,যা লক্ষ্যমাত্রার এক-শতাংশেরও বেশ কম।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থাহীনতা এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পেনশন স্কিমের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। পেনশন স্কিমের ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় আছে সাধারণ মানুষের।
অবশ্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে নতুন এ ধারণা যাতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় সেজন্য তারা কাজ করছে। তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য একটি বিধিমালার খসড়া তারা তৈরি করেছে, যা দ্রুত পাস ও কার্যকর হবে। বিনিয়োগ কমিটির মাধ্যমে এ তহবিলের বিনিয়োগ হবে। তাই সরকার সরাসরি এ অর্থ ব্যবহার করতে পারবে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রতিশ্রুতি দেয়। টানা ক্ষমতায় থাকলেও ১৫ বছর পর এসে সেটি তারা বাস্তবায়ন করে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন হয়েছে বেসরকারি কর্মচারীদের ‘প্রগতি’ স্কিমে। এ পর্যন্ত এ স্কিমে ৯ হাজার জন টাকা জমা দিয়েছেন। আর স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিযুক্তদের‘সুরক্ষা’ স্কিমে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার জন টাকা জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ বাকি দু স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ১০ হাজারেরও কম।
অন্যদিকে সতর্ক বেসরকারি চাকরিজীবীরা,কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না প্রবাসীদের কাছ থেকেও। এমন পরিস্থিতিতে ১০ কোটি মানুষকে পেনশন স্কিমের আওতায় আনার যে লক্ষ্য কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেছে,তা কবে নাগাদ পূরণ হবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, এতদিন চালু থাকা চারটি স্কিম বাধ্যতামূলক ছিল না; এগুলো সেচ্ছাধীন ছিল। আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী,দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে সার্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা। তবে এ লক্ষ্য অর্জন সময় সাপেক্ষ। একটি নতুন ধারণা যাতে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়,সে বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।
২৪ মার্চ ২০২৪
এজি