Tuesday , 7 January 2025
তাল গাছ

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও তালগাছ

এখন প্রায়শই শোনা যায় সারা দেশের কোনো না কোনো স্থানে আকস্মিক বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো এখন আর কোনো মৌসুম কিংবা ফর্মুলা কিংবা নিয়মনীতি মানছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো আর কিছুই না, তা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগে দেখা যেত বছরে বজ্রপাত হতে দু-চারজনের মৃত্যুর খবর কালেভদ্রে পাওয়া গেলেও এখন ফি-বছর বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমার এ অর্ধশতাধিক বয়সের অভিজ্ঞতায় এর আগে কখনো বজ্রপাতে এত মানুষের মৃত্যু হতে দেখিনি। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে উষ্ণতা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, গাছ কাটা, নতুন নতুন গাছ রোপণ না করা, জলাশয় ভরাট, দ্রুত নগরায়ণ- ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। আর সে জন্যই বজ্রপাতসহ প্রকৃতিতে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই চলেছে। সেগুলোর একটিই হলো বজ্রপাতে মৃত্যু। সময়ের ব্যবধানে আজ তা মহামারি আকারে দেখা যাচ্ছে। বর্ষাকাল শুরু হলেই জনমনে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।

তারপর আসছে কীভাবে এসব আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো- খালি মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পাহাড়-বন, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর তীর প্রভৃতির পাড়ে কিংবা চারপাশে উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী তৈরি করে উঁচু উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সেসব গাছই থান্ডার অ্যারেস্টার (বজ্রপাত শোষক) হিসেবে কাজ করবে। তাতে গ্রামান্তরে বজ্রপাতের দরুন কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ মারা যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন।

এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সারা দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে তিন কোটি তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি উঁচু গাছ রোপণ করতে হবে যাতে আমাদের দেশের কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুবরণ না করেন। কারণ এ দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাছাড়া শহরের সচেতন মানুষ তারা তাদের বাড়ি-ঘর বানানোর সময় আগেই পরিকল্পিতভাবে থান্ডার অ্যারেস্টার লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শোনার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সংস্থা তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছেন। এতে সম্পৃক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। তবে সবচেয়ে অগ্রগামী হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীসহ প্রশাসন ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। আমি এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব এখানে। ছড়া কবিতার কথায় আছে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। অর্থাৎ তালগাছ এক সময় সবগাছ থেকে উঁচুতে উঠে যায়।

তালগাছ সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি তালগাছ রোপণ করে, সে ব্যক্তি সেই গাছের তাল খেয়ে মরতে পারে না’। তার মানে হলো তালগাছের বাড়-বাড়তি খুবই ধীরগতিতে ঘটে; কিন্তু কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। কারণ আমি নিজে আমার বাড়িতে ১৫ বছর বয়সে যে তালগাছ নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম এখন আমার ৫৩ বছর বয়সে এসে আরও ১০ বছর আগে থেকেই সেই গাছের তাল খেয়ে চলেছি। তার থেকে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কি হতে পারে! অর্থাৎ তালগাছ লাগানোর ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই সেটা থেকে ফল খাওয়া যেতে পারে।

তালগাছ এখন আমরা যে শুধু বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগাব তাই নয়- এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার ও উচ্চ খাদ্যমান। যেমন তালের পাতা দিয়ে ঘরের মাদুর তৈরি করা হয়, তালের পিঠা, তালের রস থেকে নানারকম পিঠা, পায়েস তৈরি করা হয় যা আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্টিতে আছে তাল নবমী, তালের রস ক্যানসার প্রতিরোধী, তালগাছ দিয়ে তৈরি হয় তালের নৌকা। তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বিভিন্ন কুটির শিল্প, কাণ্ড দিয়ে বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় কাঠ ও নৌকা তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরি করা হয় যাকে সবাই ‘তাড়ি’ বলে চেনেন।

তা ছাড়া তাল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তালের রসে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাল ভিটামিন-বি এবং ভিটামিন-এ এর আধার। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো রাখতেও তালের জুড়ি নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তালে ৮৭ কিলোক্যালোরি খাদ্যশক্তি বিদ্যমান। এতে আরও রয়েছে, জলীয় অংশ- ৭৭.৫০ গ্রাম, আমিষ-০.৮ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ- ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩০ মিলিগ্রিাম, আয়রন-১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন-০.০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাবিন-০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন-০.৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন নি-৫ মিলিগ্রাম ইত্যাদি।

বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে তালের আঁটি রোপণ। এমনি একটি মহতি উদ্যোগের সঙ্গে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত তালগাছ রোপণ কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেদিন তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপক কুমার পালের নেতৃত্বে উপজেলার সবপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ তালের আঁটি রোপণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। আমি এ কার্যক্রমে একটু বেশি আগ্রহ বোধ করেছি, কারণ একে তো আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ আর সেই তালের আঁটিগুলো লাগানো হচ্ছে আমাদের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সহযোগী ছাড়াও সেখানকার বেশ কজন সংবাদকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আশা করি সামনের কয়েক বছরেই তাল, সুপারি ও নারিকেলগাছ দিয়ে ভরে উঠবে সারা দেশের আনাচে-কানাচে, যাতে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরীভূত করা সম্ভব হবে।

বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি এখন রীতিমতো মহামারি আকারে দেখা দিচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাও ঠিক যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে বা বাইরে গিয়ে কোনো-কিছু করা সম্ভব নয়; কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থাপনায় যদি সেগুলোকে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয় তবেই মঙ্গল। আর বজ্রপাতের মতো একটি নিয়ন্ত্রণহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যদি সামান্য কিছু তালগাছ রোপণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়- তবে তার থেকে ভালো কাজ আর কি হতে পারে! কাজেই আসুন প্রতি বছর আমাদের পারিপার্শে সবাই মিলে তালগাছ লাগাই এবং এর মাধ্যমে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করি।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৪ মে ২০২৪
এজি

এছাড়াও দেখুন

Exam -job

পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির ‌বৃত্তি পরীক্ষা ফিরে আসছে

পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির ‌বৃত্তি পরীক্ষা আবারও ফিরে আসছে। একসময় এ দুটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *