আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন’ (পি.এল.ও)। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ ছিল ফিলিস্থিনদের অবিসাংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান। দখলদারীর অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় ‘ হামাস ’। তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। কট্টরপন্থী সংগঠনটি ইসরায়েলকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং দেবেও না।
হামাস প্রতিবর্ণীকৃত অনুবাদ হলো -‘উদ্দীপনা’হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া বা ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন এর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হল ফিলিস্তিনের একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল যারা গাজা শহর নিয়ন্ত্রণ করে। হামাসের ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক শাখা আছে। এর প্রধান নেতৃত্বে রয়েছে হামাস সামরিক বাহিনীর প্রধান ইসমাঈল হানিয়া। যাকে বলা হয়-‘ মিসাইলের জনক’ ও ‘ ইসরায়েলের আজরাঈল।’
হামাস সামরিক বাহিনীর প্রধান ইসমাঈল হানিয়া লেবানন,মিসর, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ায় পরিভ্রমণ করে মিসাইল তৈরির ফর্মূলা নিয়ে দীঘর্ সময় গবেষণা করে এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে তৈরি করেন। তিনি এক সময় বলেছেন- ‘ ইসারায়েলের কাছ থেকে গাজা ভূ-খন্ড ও জেরুজালেমসহ মসজিদুল আসকা উদ্ধার করতে হলে হামাসকে আধূনিক অস্ত্র-সস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষিত করতে হবে।’ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্ণেল গাদ্দাফী ও বর্তমান উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট জং কিম এর পিতামহ সাবেক প্রেসিডেন্ট তাঁকে গবেষণার কাজে সহোযোগিতা করেছেন।
২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফিলিস্তিনি পার্লামেন্টে সংসদীয় নির্বাচনে অধিকাংশ আসন জয়লাভ করে। ফলে জুন ২০০৭ সাল থেকে হামাস ফিলিস্তিন অঞ্চলের গাজা ভূ-খণ্ড পরিচালিত করছে। তারপর সহিংস সংঘাতের মাধ্যমে ফাতাহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে পরাজিত করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু চীন ও সিরিয়া হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি ।
হামাস ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসাবে প্রথম ইন্তিফাদা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই যা এর আগে গাজা শাখায় ইসরায়েলের প্রতি দ্বন্দ্বহীন ছিল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। সহ-প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে বলেন,‘ হামাস সনদ ১৯৮৮ সালে নিশ্চিত করে যে হামাস আধুনিক ইজরায়েলসহ ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলি দখল থেকে মুক্ত করতে এবং বর্তমানে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা এলাকায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ ১৯৯৪ সাল থেকে দলটি প্রায়শ:ই বলে আসছে যে, ইসরায়েল যদি ১৯৬৭ সালের সীমান্তে সরে যায়, ক্ষতিপূরণ প্রদান করে, অঞ্চলগুলোতে অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দেয় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার দেয় তবে তারা একটি যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করবে।
হামাস ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সাথে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িত হয়।এটি ইসরায়েল-পিএলও পারস্পারিক স্বীকৃতির না দেয়ার পাশাপাশি অসলো চুক্তির বিরোধিতা করে। যা হামাসের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ ‘ সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য সহিংসতার ব্যবহার ’ ত্যাগ করতে এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সন্ধানে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। হামাস ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখে। পরে হামাস ২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে।
ফিলিস্তিনি আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে ২০০৭ সালে ফাতাহ থেকে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ২০০৭ সাল থেকে হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এটি ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার সম্মিলিত অঞ্চলের উপর একটি ইসলামী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র চায় এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রত্যাখ্যান করে। হামাস ২০০৫, ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে ফাতাহর সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ইসরায়েল এবং ১৯৬৭ সালের সীমান্তের সাথে আলোচনা গ্রহণ করতে শুরু করে। অনেক পণ্ডিত মনে যে- হামাসের ২০১৭ সালের সনদে, অন্তত: নীতিগতভাবে, ১৯৬৭ সালের সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করেছে।
পশ্চিম তীরে হামাসের মুরাল : ফিলিস্তিনে দু’টি দল বেশ সক্রিয়। এর একটি হামাসের নেতৃত্বে ইসমাঈল হানিয়া,অন্যটি ফাতাহ। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। এর মধ্যে হামাসের দখলে রয়েছে গাজা এলাকা। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহ’র মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ফলে সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬ এর নির্বাচনের পর। ঐ নির্বাচনে হামাস জয়ী হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিলিস্তিনে সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৭ সালে হামাস ফাতাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাজিত করে গাজার দখল নিয়ে নেয়। সেই থেকেই গাজা শাসন করছে হামাস।
হামাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি বড় আকারের আক্রমণ শুরু করে। হামাস একে ‘ অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড ’ বা ‘ আল-আকসা প্লাবন অভিযান ’ নামে অভিহিত করে। সংশ্লিষ্ট দখলদার ইসরায়েলীয় প্রত্যাক্রমণকে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী আই. ডি. এফ বা ‘অপারেশন আয়রন সোর্ডস’ বা লৌহ তরবারি অভিযান ’ নাম দেয়া হয়। সঙ্কটটি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত ও গাজা–- ইসরায়েল সংঘাতের একটি অংশ। সঙ্কটটি ২০২৩ সালে ব্যাপক সহিংসতার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
২০২৩-এ ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি কর্তৃক অবৈধ বসতি স্থাপন বৃদ্ধি, শরণার্থী শিবিরে হামলা, আসকায় প্রবেশে মুসলমানদের বাধাদান,ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণেদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলীয় বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা, জেনিনে সংঘর্ষ, ২০২১-এ সংঘাতের ফলে আল-আকসা মসজিদ,গাজায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি ও ৩২ জন ইসরায়েলী নিহত হওয়া প্রভৃতি কারণে হামাস এ ঘটনাগুলোকে আক্রমণের ন্যায্যতা হিসেবে উল্লেখ করে এবং গাজার বাইরের ফিলিস্তিনিদেরকে ‘ দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ যোগ দেয়ার আহ্বান জানায়।
কেননা-হামাসের নেতৃেত্ব মাতৃভূমি দখলমুক্ত করা এবং বায়তুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ বর্ণবাদী ইহুদীদের কবল থেকে মুক্ত করার প্রশ্নে কোনো আপোস কামিতা বা লেনদেনের ঘোর বিরোধী। হামাস নেতাদের বক্তব্য হলো-আপোস করে ফিলিস্তিনের সেক্যুলার নেতৃত্ব ইসরাইলের কাছ থেকে কোনো ছাড় আদায় করতে পারেনি বরং তাদের আপোসকামিতার সুযোগ নিয়ে বর্ণবাদী ইহুদী নেতারা ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে – ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ড এবং পবিত্র শহর বাইতুল মোকাদ্দাস মুক্ত হতে পারে একমাত্র ‘ সংগ্রামের মাধ্যমে ’।
তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির আপোস প্রক্রিয়ার উপর হামাসসহ ফিলিস্তিনের সংগ্রামী দলগুলো আস্থা রাখতে পারছে না। তারা মনে করেন- যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদেই ফিলিস্তিনের ভূমি জবরদখল করে সেখানে ইসরায়েল নামক ইহুদীবাদী রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভবপর হয়েছে। আর এ দু’পশ্চিমা শক্তির সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তায় এখন পর্যন্ত অবৈধ ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিনে জবরদখল বজায় রাখতে এবং সেখানে অব্যাহতভাবে হত্যা, গুম, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, উদ্বাত্তুস্মরণার্থী শিবিরে হামলা,আসকায় প্রবেশে মুসলমানদের বাধাদান, ফটকে গোলাগুলি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে দখলদার বর্ণবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল পার পেয়ে যাচ্ছে।
তথ্য সূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া ও ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত। বর্তমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাধারণ পাঠকদের জন্যে পরিবেশিত হলো। সম্পাদনা : আবদুল গনি,শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী, চাঁদপুর। জানুয়ারি ২,২০২৪ ।