মধ্যযুগের শুরু থেকে বঙ্গভূমিতে ইসলামের শাখা-প্রশাখা বিস্তীর্ণ হতে থাকে। ফলে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির জন্য দ্রুতগতিতে মসজিদ নির্মাণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নান্দনিক ও শৈল্পিক মসজিদের বেশির ভাগ সুলতানি ও মোগল আমলে নির্মাণ করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে মসজিদ মুসলমানদের ইবাদতখানা।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মসজিদ। প্রাক-ইসলামি যুগ থেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রে মসজিদের কল্যাণমুখী কার্যকারিতা লক্ষণীয়। যদিও তা হিজরতের পর পরিপূর্ণ অবয়ব ধারণ করে। ইসলামের স্বর্ণযুগে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, বিচারিক সব ক্ষেত্রে মসজিদের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার দেখা যেত। তৎকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার পদচারণা ছিল। রাসুল (সা.) মসজিদে নববিতে বসে মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দিতেন।
যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের ন্যায় ছিল। এ ছাড়াও ইসলামি শিক্ষার প্রসারে অন্যতম ছিল বাগদাদের বাইতুল হিকমা, যা জ্ঞান চর্চার জন্য বহু শতাব্দী প্রসিদ্ধ ছিল। শিক্ষা ছাড়াও মসজিদে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হতো। মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকার সব আইন ও বিচার সংক্রান্ত কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মসজিদ। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনাও হতো মসজিদে। বদর ও উহুদ যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি নিযুক্ত করা, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনার সবকিছুই মসজিদে হয়েছিল।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সমাজে মসজিদের ভূমিকা ক্রমেই কমে আসতেছে। মসজিদ শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে সামাজিক বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ মসজিদ বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করা ইমানের দাবি। সমাজে ন্যায় ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। যার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তার মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদে ইমামের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। একজন ইমাম শুধুমাত্র মসজিদ কমিটির বেতনভুক্ত কর্মচারী নয় বরং তিনি সমাজের নেতা তথা মসজিদভিত্তিক সমাজের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সমাজের যেকোনো সমস্যায় কোরআন ও হাদিসের আলোকে তার কথাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমাদের সমাজে ইমামের ক্ষমতার অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়।
বেতন-ভাতার দিক দিয়ে একজন ইমামের আয় সাধারণ দিন মজুরের চেয়েও কম। মসজিদে ইমামতি, জানাজার নামাজ এবং বিভিন্ন জায়গায় দোয়া পড়ানোর মধ্যেই ইমামের কার্যাবলি সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ইমামের ওপর সমাজপতিদের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। ইমামকে ব্যবহার করা হয় সমাজপতিদের ঢাল হিসেবে। তাই সমাজের প্রভাবশালী কিন্তু মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা কম, এমন ব্যক্তিদের র্কর্তৃত্ব থেকে মসজিদকে মুক্ত রাখতে হবে। ইমামকে জোরপূর্বক প্রভাবিত করার সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন।
মসজিদের সব প্রকার কাজে মসজিদমুখী তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একজন ইমামকে প্রাপ্য মর্যাদা দানের পাশাপাশি সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে। তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। মসজিদভিত্তিক সমাজের একটি রূপরেখা তৈরি করা জরুরি। প্রথমত শিশুদের ইসলামি শিক্ষার বিকাশ সাধন করতে হবে। ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিকতায় উদ্ভাসিত করার জন্য শিশুদের মক্তবে পাঠানোর ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করতে হবে। বর্তমানে গ্রাম গঞ্জের কিছু মসজিদে মক্তবের প্রচলন থাকলেও তাতে উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়।
একই সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে এসে অভিভাবকদের তীব্র অনিহাও দৃশ্যমান। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে একটি দাওয়াতি গ্রুপ তৈরি করে অভিভাবকদের ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে শিশুদের সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রণোদনা ও উপহারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।ঈদ উপলক্ষে মসজিদের ইমামের তত্ত্বাবধানে নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজ করা যেতে পারে।
ঈদুল ফিতরে মসজিদ কমিটির আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে বঞ্চিত শিশু ও বৃদ্ধদের ঈদ সামগ্রী বিতরণ করা যেতে পারে। ঈদুল আজহায় কোরবানির গোশতের একটি অংশ মসজিদে জমা করে ইমামের নেতৃত্বে অসহায় ও কোরবানি দিতে অক্ষম মানুষদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।
এভাবে ধর্মীয় উৎসবগুলো মসজিদকেন্দ্রিক করা যেতে পারে, যা মসজিদভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হবে। এ ছাড়াও আকিকা, সুন্নতে খতনা, বিবাহের মতো সামাজিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান মসজিদ কেন্দ্রিক করা যেতে পারে। এভাবেই তৈরি করা যেতে পারে একটি মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ।
লেখক : কাজী খবিরুল ইসলাম,ইসলামী চিন্তাবিদ
৩ জুলাই ২০২৪
এজি