বাংলাদেশের জাতীয় কবি বাঙালীর কবি,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্যবার সুজলা, সুফলা,শ্যামল, নদীমাতৃক বাংলাদেশে আসেন। কবি কলকাতা থেকে মনের টানে কিংবা দেশবাসীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অনেকবার আসেন।
তিনি এসে এদেশবাসীকে গান,গজল,কবিতা,বক্তৃতা শুনিয়েছেন। কবি কাজী নজরুল সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি দেশের দক্ষিণাঞ্চল বরিশালে আসেন। বরিশালে সর্বপ্রথম শেরে-এ-বাংলা ফজলুল হকের ভাগ্নে মো.ইউসুফ আলীর আমন্ত্রণে বরিশাল বেড়াতে আসেন। ১৯২১ সালে আবার আমন্ত্রণ পেয়েই কুমিল্লায় আসেন। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সংবর্ধনায় তিনি যখন আমন্ত্রণ পান তখনই বাংলাদেশে আসতেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লাবাসীর জামাতা। তাই তিনি ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ বার কুমিল্লায় আসেন। কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে কাটান ১১ মাস। এর মধ্যে নার্গিসদের বাড়ি অতিথি হিসেবে বেড়ান প্রায় ৪১ দিন ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ২৩ চৈত্র থেকে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় পর্যন্ত। সেখানে তিনি ১৬০ টি গান ও ১২০ টি কবিতাই লিখেন। তাঁর জীবনে যে দু’জন নারী এসেছিলেন তারা দু’জনই কুমিল্লার।
প্রথম জন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির আলী আকবর খানের ভাগিনী নার্গিস আক্তার খানম। অপরজন কুমিল্লা শহরের ইন্দ্রকুমার সেনের ভাতিজি ও বসন্তকুমার সেন ও গিরিবালার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা দুলী। তার বাবা মারা গেলে আশালতা তার মা গিরিবালার সাথে কুমিল্লা কান্দির পাড় জেঠার বাসায় উঠেন।
কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি যেমন কবিতা, গান লিখেছেন,সংস্কৃতি চর্চা করেছেন,তেমনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছেন। হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে কুমিল্লার রাস্তায় ইংরেজ বিরোধী গান গেয়েছেন। বৃটিশ সরকার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতারী পরোওয়ান জারি করে। তা এড়ানোর জন্যে কুমিল্লা আসেন ও পরে এ কারণে গ্রেফতারও হয়েছেন কুমিল্লায়।
কুমিল্লায় কারাবরণ করেছেন কিছুদিন। মুরাদনগরের দৌলতপুর, কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ার ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ি, ধর্মসাগর পাড়, রাণীর দীঘির পাড়, মহেশাঙ্গন,দারোগা বাড়ি , টাউন হল ময়দান, সঙ্গীতজ্ঞ সচীনদেব বর্মনের বাড়ি,নবাব বাড়িসহ কুমিল্লার আনাচে-কানাচে তাঁর পদচারণার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে।
তিনি ১৯২১ সালে এপ্রিলে আখাউড়া দিয়ে রেলপথে কুমিল্লায় আসেন। পথেই ট্রেনে বসে তিনি ‘নীলপরি ’নামক কবিতাটি রচনা করেন। এটি ছিল কুমিল্লায় প্রথম আসা। দ্বিতীয় বার নভেম্বরে আবার আসেন কুমিল্লায়। সে সুবাধে ১৯২১ সালের ৮ জুলাই অল্প সময়ের জন্যে-চাঁদপুরের তৎকালীন বর্তমান সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পাশে বা বিপরীতে অবস্থিত হাসপাতালের পশ্চিমে পাশে ডাক বাংলোয় একরাত্রি অবস্থান করেন। এসময় সাথে ছিলেন বন্ধ’ মুজ্জাফর আহমেদ। ১৯২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে তৃতীয়বার , ডিসেম্বর চতুর্থবার এবং ১৯২৩ সালে পঞ্চমবার কুমিল্লায় আসা হয়।
১৯২৪ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে কুড়িগ্রামে হাই স্কুলে একটি মিলাদ মাহফিলে যোগদান করতে কুড়িগ্রাম যান। ১৯২৫ সালে প্রথমে কবি নজরুল বঙ্গীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান করত ফরিদপুরে আসেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে ভারতের মহাত্মাগান্ধী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। ওই বছর দ্বিতীয়বার আবার ফরিদপুর ও রংপুরে আসেন।
১৯২৬ সালে কুলাউড়া হয়ে রেলপথে আবার কুমিল্লা হয়ে চাঁদপুর দ্বিতীয়বার আসেন। ১৯২৬ সালের ৬ মার্চ কৃষ্ণনগর থেকে হেলাল কনফারেন্সে যোগ দান করত এবার জুন মাসে হেমন্তকুমারের সাথে ঢাকায় আসেন এবং কিছুদিন থাকেন। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কোন একসময় আসেন ও সিলেট সফর করেন। এ বছরের অক্টোবরে কবি কেন্দ্রিয় আইনসভার প্রার্থী হিসেবে স্বরাজ্য দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকায় দ্বিতীয়বার আসেন। ১৯২৭ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি পুনরায় ঢাকায় এবং আবার ১ মাস পর মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি আবারও ঢাকায় আসেন।
১৯২৭ সালে জুন মাসে বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দলের সম্মেলনে কৃষ্ণনগর থেকে সপরিবারে কুষ্টিয়া, ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে ল²ীপুর আইন সমিতির টাউনে আসেন। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি আবার সিলেট আসেন। এ সালে চুয়াডাঙ্গায় জেলার দামুর হুদা থানার কার্পাস ড্াঙ্গায় সফর করেন। এ সময় তাঁর সাথে প্রমীলা, বুল বুল ও গিরিবালা ছিলেন।
১৯২৮ সালে তৃতীয়বার তিনি গোয়ালন্দ থেকে স্ট্রীমার যোগে আবার চাঁদপুর আসেন এবং সিলেটে ট্রেন যোগে চলে যান। শেষের দু’বারে কোথায় অবস্থান করেন বা আদৌ স্টীমার থেকে কোথায়, কখন নামেন, তার তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। ১৯২৮ সালে ১৬ ডিসেম্বর মুসলিম ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবসে রাজশাহী , ১৯২৯ সালে তিনি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম । ১৯২৯ সালের ১৬ মার্চ কবি জয়পুর হাট জেলার আক্কেলপুর সংবর্ধনায় আসেন। এ সালে আবারও বগুড়া এডওয়ার্ড পার্কে ‘বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন।
১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে রাজবাড়ি, ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির আসন অলংকৃত করার উদ্দেশ্যে আসেন। ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগদান কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ১৯৪২ সালের পর থেকে অসুস্থ থাকায় আর আসা হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের মন্ত্রীসভায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ’ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ’এ গানটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত চল চল চল- আমাদের রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা ও বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সার্বিক নির্দেশে ও তাঁর মন্ত্রীসভা কবিকে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণসহ যোগাযোগ শুরু করেন।
গৃহীত সিন্ধান্ত মতে-ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আনা হয় খুবই গোপনে। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধু ফোনেই সবকিছু আলাপ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে বিদ্রোহীকবি নজরুলকে বাংলাদেশে আনার বিষয় মিমাংসা করার মত পরিবেশ তৈরি করা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়েছে ।
১৯৭২ সালের ২৪ মে ভোর রাতে কলকাতার সিআইটি বিল্ডিং এর ফ্ল্যাট- ৪ , ব্লক এল , ক্রিস্টেফার রোডের বাসা থেকে সবার অগোচরে কবিকে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে আনামাত্রই বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমানে তুলে তৎকালীন ঢাকা বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়।
সাথে ছিলেন কবির দু’পুত্র কাজী সব্যসাচী,কাজী অনিরুদ্ধ,উমা কাজী, কবির নাত-নাতনী,দু’জন পরিচর্যাকারী সেবক উসা সাউ ও কটি সাউ। কবিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবির মর্যাদা ও নাগরিত্ব দিয়ে ঢাকায় একটি বাড়ি উপহার দেন। বাড়িটি হলো-৩৩০/ বি, কবি ভবন,ঢাকা। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশের এ বাড়িতেই কাটে। চিকিৎসা বোর্ড গঠন করে যথেষ্ট চিকিৎসা সত্তে¦ও বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলামের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ সালের ১৯ মে কাজী নজরুলকে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল নেয়া হয়েছিল।
এ সময় তাঁর পরিবারের ক’জন সদস্য তারঁ সাথে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ নিনি মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবিকে অসুস্থজনিত কারণে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
কাজী নজরুর ইসলামকে ঢাকায় আনা ও তাঁর জন্য সরকারিভাবে বাড়ি প্রদান, মেডিকেল বোর্ড গঠন, কবি ও তাঁর পরিবারের দেখাশুনা ও চিকিৎসা সেবা প্রদান,পরবর্তীতে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি-এ সবই বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহ ও নির্দেশ করা হয়েছে।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালের একটি কেবিনে। ১৯৭৬ সাালের ২৯ আগস্ট ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে দীর্ঘ ১ বছর ১ মাস ৮ দিন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে ৭৭ বছর বয়সে ও প্রায় ৩৫ বছর বাকরুদ্ধ অবস্থায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
অত:পর ঐ দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। তিনি তাঁর একটি গানে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’কবির এ ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযাযী তাঁর সমাধি রচিত হয়।
এদিকে কবিপত্নী প্রমীলা নজরুলও ১৯৩৯ সালে পক্ষাঘাতজনিত দীর্ঘ ২৩ বছর অসুস্থতাবস্থায় থাকার পর ১৯৬২ সালের ৩০ জুন কলকাতায় মৃতুবরণ করেন। তবে কবিপত্নী প্রমীলার শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর স্বামীকে যেন তাঁর কবরের পাশে চুরুলিযায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্ত বাস্তবতার নিরিখে ও পরিস্থিতিতে প্রমীলার শেষ ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়ে উঠে নি।
এদিকে কবির মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত সেবক উসাসাউ প্রায় ৪২ বছর কবির সেবাযতœ করায় পিজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালেই একটি চাকুরি দেন। তিনিও ১৯৮০ সালে এ হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র:নবারূণ ও সচিত্র মাসিক পত্রিকা,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘কাজী নজরুলের জীবনী’এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি)
লেখক: আবদুল গনি, শিক্ষক ,সাংবাদিক , প্রাবন্ধিক ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ ,চাঁদপুর। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪