স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ এবং বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ঐতিহাসিক নানা ঘটনায় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।
স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু টিভি চ্যানেল, অনেক সংবাদপত্র। আর সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে,যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
এ লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য এবং সেই সুশাসন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সদিচ্ছার সাথে সাথে গণমাধ্যমের প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার লিপম্যান জনমত সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মাধ্যম (Media) যা করে তাই জনমত’। তিনি তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ সাধারণত রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মতামত তৈরি করে।
জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের বিকাশের সাথে জনমতের ধারণাও বিকশিত হয়।’ আর জনমতের প্রতিফলনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ। অপরদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার লিপম্যান জনমত সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্র হলো একটি শক্তিশালী মাধ্যম। বর্তমান যুগে জনমত গঠনের জন্য যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথ্যাদির উপর নির্ভর করতে হয় সেগুলোর জন্য সংবাদপত্রের প্রয়োজন অত্যধিক।
গণশিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে জনমত গঠনে সংবাদপত্রের প্রভাব ও ক্ষমতা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধ্যাপক ফাইনার বলেছেন যে, ‘সংবাদপত্র কেবল সংবাদই পরিবেশন করে না, এটা জাতীয় সমস্যাদির উপর মতামত ব্যক্ত করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে’। সংবাদপত্র দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও মনীষীদের প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশ করে জনমত গঠনে সাহায্য করে থাকে। জাতীয় নির্বাচন ও বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশন, বিশেষজ্ঞদের কলাম ও মতামত এবং বিশেষ ফিচার প্রকাশের মাধ্যমে জনমত গঠন করে থাকে। আবার সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনসাধারণ তাদের মতামতও প্রকাশ করতে পারে।
সরকার ও জনসাধারণের মূখপত্র হিসেবে সংবাদপত্রের সমালোচনার ভয়ে সংযত থাকে। এ-কারণেই বলা হয়, গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো স্বাধীন সংবাদপত্র (Free Press)। তবে ধনতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ব্যবসায় হিসেবেই পরিচালিত হয়। বর্তমানে মালিকানাস্বত্ব মুষ্টিমেয় মূলধন-মালিকদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সংবাদপত্রের আয়ের অধিকাংশ আসে ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপন থেকে।
সুতরাং পুঁজিপতিদের স্বার্থবিরোধী কোন সংবাদ যে প্রকাশিত হবে তা আশা করা অযৌক্তিক। অপরদিকে সংবাদপত্রের মালিকরা নিজেরাই পুঁজিপতি। তাই তাঁরা যে সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় মুনাফা করছেন সেই সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।
গণমাধ্যম ও সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে সমাজকে ঘিরে। গণমাধ্যম সর্বপ্রথম মানুষের তথ্যের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছে। এটি মানুষের কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে এবং করে যাচ্ছে।
সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে গণমাধ্যমেরও বিকাশ ঘটেছে। চরিত্র এবং চেহারাগত পরিবর্তন এসেছে ব্যাপকভাবে। একেক যুগে মানুষ একেক ধরনের মূল্যবোধ লালন করেছে এবং গণমাধ্যম সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে সেসব মূল্যবোধের প্রসার ঘটিয়েছে। সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের যে দায় এবং যে দায়িত্ববোধ, সেটি সত্যিকারার্থে যুগে যুগে প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে। সমাজ ও সামাজিক-ব্যবস্থাকে সঠিক পথে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সবসময় অসামান্য অবদান রেখেছে। তবে বিচ্যুতিও আছে। থাকাই স্বাভাবিক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে তথ্যপ্রবাহের জগতে চটুলতা,রুচিহীনতা প্রভৃতি কাজ একটি বড় জায়গা করে নিয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিকদের কাজ হলো চটুলতা পরিহার করে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ যতই সামাজিক মাধ্যমে গা ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা সত্যের সন্ধান করবেই।
গণমাধ্যমে সেই সঠিক তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সঠিক তথ্যপ্রবাহ এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। তবে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং সাংবাদিকতার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সাংবাদিকদের সংখ্যাও বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই সাংবাদিকরা পেশাগত মান ও সমাজের প্রত্যাশা পূরণে অনেকটা ব্যর্থও হচ্ছেন।
বলতে গেলে বলতে হয়, অধুনা সাংবাদিকতার বেশ কিছু সংকট বা সীমাবদ্ধতা এবং তার সাথে সমালোচনাও আছে, অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকতা যতটা শরীরের রূপে বেড়েছে ততটা অন্তরে বা কমিটমেন্টে বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ‘এডভারটাইজমেন্ট’ এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যই মুখ্য হয়েছে।
এসব অভিযোগ যদি আমলে নেই, না নেওয়ারও সঙ্গত কারণও নেই, তাহলে বর্তমান সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা খুঁজলে মোটা দাগে দেখতে পাই, আগেকার দিনের মতো মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ এখন কেবল স্বৈরাচারী সরকার বা রাষ্ট্রনায়ক নয়। পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলেছে। বিশ্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রভূত বদলেছে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক হয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নানাবিধ চতুর আইনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়।
এর বাইরেও আরো বহুবিধ প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়েছে-১. বড় পুঁজির আধিপত্য ২. বাণিজ্যকরণের আধিপত্য ৩. অসহিষ্ণু দল ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্য ৪. ধর্মীয় উগ্রবাদের আধিপত্য ৫. সাংবাদিকদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক প্রভাব ৬. জনস্বার্থ বিবেচনা বা কমিটমেন্টের ঘাটতি ইত্যাদি। এরপরও আরো কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে যা সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। এরপরও বলতে হবে, বর্তমান যুগে সাংবাদিকতার প্রভাব ও প্রসার বেড়েছে,সেই সাথে বেড়েছে সংকটও। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পেশা, এ পেশা মহত্ত্বের দাবিদার। এই পেশা সংবাদকর্মীদের জন্যে কেবলই চাকরি নয় কিংবা সংবাদশিল্পের মালিকদের জন্যে কেবলই ব্যবসায় নয়। অনেক ক্ষেত্রে এর অন্যথা ঘটে বলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়।
বিশ্বব্যাপি প্রেস ফ্রিডমের অবস্থা, ইউনেস্কোর রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৫ জন সাংবাদিককে তাদের কাজের কারণে খুন হতে হয়েছে। ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫২ নম্বরে। সাংবাদিকতার জন্য যে দেশগুলোকে খারাপের তালিকায় ফেলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
১৮০ দেশের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে নরওয়ে। তারপরে আছে ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ডেনমার্কের নাম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ১০৭, শ্রীলঙ্কা ১২৭ ও মিয়ানমার ১৪০ নম্বরে রয়েছে। এ তিন প্রতিবেশী দেশের র্যাংকিং বাংলাদেশ থেকে ভালো। গত পাঁচ বছরে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংসই তাদের দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সাক্ষী। আজকের দিনে স্বাধীনভাবে কাজ করার মৌলিক অধিকারের দাবিতে সরব আপামর সাংবাদিককুল। এবং সরব হওয়াও উচিত।
আমাদের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে।
লেখক পরিচিতি :অধ্যাপক মো.হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা,সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।