Monday , 7 October 2024
cow ----

এবার কোরবানির পশুর হাটে ৯৫ ভাগই দেশি গরু

সারাদেশে কোরবানির পশুর হাটে কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। ঈদুল আজহার রাজধানীর দু সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থায়ী ২টিসহ ২০টি পশুরহাটে দেশি গরুতে ছেয়ে গেছে। ১০ বছর আগেও বাংলাদেশের কোরবানির ঈদের হাটে দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরুর আধিক্য দেখা যেত। এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে। প্রত্যেকটি হাট এখন দেশি গরুতে ভরপুর।

২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার হঠাৎ করে ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশে বন্ধে সীমান্তে কঠোর অবস্থান নেয়ায় এখন দেশের কৃষক ও ছোট বড় খামারিদের গরুই ঈদের কোরবানির চাহিদা মেটাচ্ছে। কয়েক বছরে দেশে সাধারণ মানুষ ও খামারিরা গরু ছাগল প্রতিপালনের নজর দিয়েছে।

কোরবানির পশু বেচা-বিক্রি শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। আজ শুক্রবার পুরোদমে বেচাকেনা হবে বলে খামারি ও গরুর পাইকারদের প্রত্যাশা। এক সপ্তাহ আগ থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কোরবানির পশু নিয়ে হাটগুলোতে আসতে শুরু করেন খামারিরা। গতকাল বিকেলে মুসলধারে বৃষ্টিতে কদমাক্ত হয়ে পড়ে হাটগুলো।

রাজধানীর শনির আখড়া, কমলাপুর, সারুলিয়া, গাবতলীয় পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, সবখানে দেশি গুরুর আধিক্য। ভারতীয় ও মিয়ানমারের গরুর সংখ্যা খুবই কম। ক্রেতা ও বিক্রেতারা জানান, এ বছর কোরবানিতে দেশি গরুর চাহিদাই বেশি। পশুরুহাটগুলোতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গরু বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বললে তারা জানান, রাজধানীর পুশুর হাটে এখন পর্যন্ত যেসব গরু উঠেছে তার ৯৫ ভাগই দেশি জাতের গরু।

বিদেশি জাতের যে ৫ ভাগ গরু উঠেছে তার বেশির ভাগ আকারে বিশাল। লাল-সাদা, কালচে সাদা এবং ডোরাকাটা ধূসর রঙের সংমিশ্রণের অধিকারী এদের দেখতে বেশ সুন্দর দেখালেও ক্রেতার কাছে তাদের চাহিদা কম। অপরদিকে কোরবানি দিতে সক্ষম এমন বেশির ভাগ মানুষ হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব-নিকাশটা খুব জটিল। সামর্থ্যরে মধ্যে আকারে ছোট ও মাঝারি গরুই বেশি খোঁজেন। এ কারণে দেশি গরুর বিক্রি বেশি। দেশে কৃষকদের সংখ্যা দ্রæত বাড়ছে, বিশেষ করে শহরের কাছাকাছি এলাকায় এখন আধা বাণিজ্যিক বা পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্যোগে বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে ডেইরি ফার্ম। এসব গরুর খামারে বেশিরভাগ গরুই দেশি যার চাহিদা কোরবানির সময় বেড়ে যায়।

রাজধানী ঢাকার স্থায়ী পশুর হাট গাবতলী ও সারুলিয়ায়সহ সব পশুর হাটে আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। রাজশাহী, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের নানান প্রান্ত থেকে ট্রাকে করে গরু আসছে রাজধানীর স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটগুলোতে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থায়ী দুইটিসহ ২০টি পশুরহাটে আনুষ্ঠানিকভাবে কোরবানির পশু বেচা-বিক্রি শুরু হচ্ছে। পশুর হাটগুলোতে চলছে এখন শেষ মুহ‚র্তের প্রস্তুতি। তবে এখন থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কোরবানির পশু নিয়ে হাটগুলোতে আসতে শুরু করেছেন খামারিরা।

কোরবানির সময় পশু আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কোরবানির পশু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বছরে এখন এক কোটিরও বেশি পশু কোরবানি হয় বাংলাদেশে যার বাজার মূল্য প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে, যার পুরোটাই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত। এর মধ্যে ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৭১৬টি গরু ও মহিষ, ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১টি ছাগল-ভেড়া ও ১ হাজার ৮৫০টি অন্যান্য পশু রয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রায় এক কোটি করে পশু কোরবানি হয়। এই হিসাবে এবার কোরবানির চাহিদা পূরণ করে আরও প্রায় ২৩ লাখ কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছরে কোরবানির পশুর চাহিদা ১-২ শতাংশ করে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ২০২৩ সালে ১ কোটি ৪১ হাজার পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছিল।

এ বছর ১ কোটি ১ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ পশু কোরবানি হতে পারে। তবে দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এ সংখ্যা কিছুটা কমেও যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্র্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার গরু ও মহিষ কোরবানি দেয়া হয়েছিল।

চলতি বছরও প্রায় একই পরিমাণের গরু-মহিষ কোরবানি হতে পারে। কোরবানির জন্য প্রস্তুত প্রতিটি গরুর গড় মূল্য ৮০ হাজার টাকা করে বিবেচনায় নেওয়া হলে চলতি কোরবানির গরুর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ৩৭ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।

গত বছর প্রায় ৫৩ লাখ ৫২ হাজার ছাগল ও ভেড়া কোরবানি হয়েছিল। গড়ে ১২ হাজার টাকা করে এসব পশুর বিক্রয় মূল্য বিবেচনায় বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া মিলিয়ে কোরবানির পশুর বাজার মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৪৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও পশুর হাট থেকে বিক্রি হওয়া জবাইকৃত কোরবানির পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪২ হাজার। এর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু, ১ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫টি মহিষ, ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৮টি ছাগল, ৫ লাখ ২ হাজার ৩০৭টি ভেড়া এবং ১ হাজার ২৪২টি অন্যান্য পশু কোরবানি হয়েছে।

তবে খামারিরা জানিয়েছেন, খাবারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবার পশু উৎপাদনের খরচও বেশি। সে ক্ষেত্রে এবার কোরবানির পশুর দামও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার নিশ্চয়ই কোরবানির পশুর বাজার বাড়বে। কেননা, পশু পালনে ব্যবহৃত সব ধরনের খাদ্য উপকরণের দাম বেড়েছে। সেই অনুযায়ী গরুর দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়তি থাকবে। তা ছাড়া দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রতি বছর কোরবানির পশুর চাহিদা বেড়ে থাকে। পাশাপাশি আমাদের কৃষকরাও পাল্লা দিয়ে গরু উৎপাদন করছেন। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ের উৎপাদন দিয়ে আমাদের চাহিদা মিটিয়ে ২০-২৫ লাখ কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকে।

শনির আখড়া হাটে গরু কিনতে আসা রাইসুল ইসলাম বলেন, চার-পাঁচ লাখ টাকায় কোরবানি দেবেন দেশে এমন লোকের সংখ্যা কম। আবার যারা দিতে সক্ষম তারা ৫ থেকে ৭ লাখ টাকায় একটি গরু না দিয়ে তার চাইতে ছোট দুই-তিনটি গরু কোরবানি দিচ্ছেন। আমি নিজেও দুটি গরু কিনবো। তবে আকারে মাঝারি সাইজের গরুই কিনবো। দেশি গরু কিনবো কারণ দেশি গরুই আমার পরিবারের সবার পছন্দ।

বাড়িতে পালন করা ৬টি গরু নিয়ে শনির আখড়া হাটে এসেছেন মানিকগঞ্জের আবু তাহের। তিনি বলেন, গরুগুলোর বয়স হবে চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। লাল ও কালো কালারের গরুগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। একই বয়সের হওয়ার কারণে দামের দিক থেকে তেমন পার্থক্য নেই। সামান্য কমবেশি হতে পারে। এক একটি ১০ থেকে ১১ লাখ টাকা দাম চাচ্ছেন তিনি।

দু সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় গাবতলীর স্থায়ী হাটসহ ৯টি হাট এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সারুলিয়া স্থায়ী পশুর হাটসহ ১১টি হাট বসেছে। তবে এ বছর আদালতের নির্দেশনার কারণে আফতাবনগরে হাট বসবে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের তথ্য কর্মকর্তা পিয়াল হাসান জানান, রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবে স্থায়ী ১টি ও অস্থায়ী ৮টি হাট। এবার বৃহস্পতিবার থেকে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত ৫ দিন হাট বসবে।

কোরবানির পশু কেনা-বেচা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দে যাতে করা যায় সে জন্য উত্তরের হাটগুলোতে সকল ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক তত্ত¡াবধানে ইনস্ট্যান্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে যে কেউ টাকার লেনদেন করতে পারবে। এজন্য হাট এলাকায় অসংখ্য ব্যাংক বুথ থাকবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, সারুলিয়ায় স্থায়ী হাটসহ ডিএসসিসি এলাকার ১১টি স্থানে পশুর হাট বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসবে। প্রত্যেকটি হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য একটি করে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।

প্রতিটি কমিটিতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। এছাড়া ডিএসসিসির নির্ধারিত গাইডলাইনের বাইরে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে সাথে-সাথে তারা ব্যবস্থা নেবেন। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পাশাপাশি প্রত্যেকটি হাটে একটি করে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত¡াবধানে নগদ অর্থের লেনদেন ছাড়া ইনস্ট্যান্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতারা অর্থের লেনদেন করতে পারবেন। এজন্য পর্যাপ্ত ব্যাংক বুথের ব্যবস্থা থাকবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক উৎপাদন ড.এ বি এম খালেদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, এ বছর কোরবানির জন্য দেশে পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় পর্যায়ের খামারিদের প্রচেষ্টায় পশু উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ফলে কোরবানির চাহিদার পুরোটা দেশীয় উৎপাদিত পশু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।

১৪ জুন ২০২৪
এজি

এছাড়াও দেখুন

Army-620x330

সেনাবাহিনীর হাতে যেসব ক্ষমতা থাকছে

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *